মাদারীপুরের আব্দুল মালেক হাওলাদার

মানুষ গড়ার এক নিপুণ কারিগরের গল্পগাথা

আয়শা সিদ্দীকা আকাশী, ১২ নভেম্বর (শীর্ষ নিউজ ডটকম): সমাজে ঝরে পড়া শিশুদের মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার এক নিপুণ কারিগর মাদারীপুরের আব্দুল মালেক হাওলাদার। দীর্ঘ ৬৭ বছর ধরে নিরলসভাবে হাজারো ঝরে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষা দিয়ে আসছেন প্রচারবিমুখ এ মানুষটি। নিজের গড়া স্কুলে তিনি একাই চালিয়ে যাচ্ছেন তার মানুষ গড়ার ব্রত।দুধখালী ইউনিয়নের মিঠাপুর বাজারে ১৯৪৩ সালে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন আব্দুল মালেক। পরবর্তীতে স্কুলটি ‘আব্দুল মালেক হাওলাদারের পাঠশালা’ নামে এলাকাজুড়ে খ্যাতি লাভ করে।

তার থেকে বড় কথা হাজারো নিরক্ষর ও অসচেতন মানুষের মনে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে নিরক্ষরতা ও অশিক্ষার অন্ধকার থেকে তুলে এনে অনেককে তার এ পাঠশালায় শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন। আজ তাদের অনেকেই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, গণ্যমান্য সুধীজন। কুলপদ্বি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আক্তার হোসেন বলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখা-পড়ায় অমনোযোগী ছিলেন। ১৬ বছর বয়সেও পড়াশুনা করতেন না। একদিন মালেক স্যার তাকে ডেকে নিয়ে তাঁর স্কুলে পড়াশুনার ব্যবস্থা করে দেন। মাত্র সাড়ে ৩ বছর তার কাছে লেখাপড়া শিখে প্রাইভেটে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন তিনি। তখন যদি তাকে ধরে নিয়ে ওই মানুষটি লেখাপড়া না শেখাতেন তাহলে আজ তিনি শিক্ষক হতে পারতেন না। চিরদিন অশিক্ষিতই থেকে যেতেন। গর্বের সাথে কথাগুলো বললেন আক্তার হোসেন। অপর এক ছাত্র বর্তমানে ব্যাংক কর্মকর্তা আজাহারউদ্দিন খানও বলেন একই কথা। তাকে ধরে এনে পড়াশুনা শিখিয়েছেন মালেক স্যার। এমনি করে অসংখ্য ঝরে পড়া ছেলে-মেয়েদের তিনি শিক্ষিত করে তোলেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার, ব্যাংক কর্মকর্তা, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তা এবং উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেক কৃতি মানুষই তার কাছে লেখাপড়া শিখেছেন।
অথচ তার খবর কেউ রাখেন না। বার্ধক্যে জরাজীর্ণ শতবর্ষী এ মানুষটির দিন কাটে বড় কষ্টে। এ বয়সেও আব্দুল মালেক হাওলাদারকে জীবিকা নির্বাহের জন্য শিক্ষকতার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা এবং জামা-কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতে হয়। ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি সামাজিক ও দেশপ্রেমমূলক কার্যক্রম দেশব্যাপী ‘সাদা মনের মানুষ’ নির্বাচন ২০০৬ সালে ১০ জনের মধ্যে তাকে নির্বাচিত করেছিলেন সাদা মনের মানুষ হিসেবে। ইউনিলিভারের পক্ষ থেকে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন ১ লাখ টাকা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আ. মালেক হাওলাদারের পাঠশালার সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি তার নিজ জেলাতেই কোনো সংবর্ধনা পাননি। এমন কি নিঃস্বার্থ এ মানুষটির খবরও কেউ রাখেন না।
মহান এ মানুষটির কাছে তার মহৎ কর্ম ও জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি শীর্ষ নিউজ ডটকমকে বলেন, প্রাপ্তির জন্য তিনি কোনো কিছু করেননি। তিনি মনে করেন এটা তার মানসিক তৃপ্তি ও নৈতিক দায়িত্ব। তার দীর্ঘ ৬৭ বছরের সাধনায় এলাকার অনেক ঝরে পড়া ছেলে-মেয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত। এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাছাড়া অনেক অসহায় ও দরিদ্র ছেলে-মেয়েকে তিনি বিনামূল্যে লেখাপড়া শেখান এটাও তার সৌভাগ্য। হাস্যোজ্জল মুখে কথাগুলো বলেন তিনি। ঠিক কবে থেকে এ পাঠশালা শুরু করেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩ বছর সিভিল গার্ডের কমান্ডার এবং কিছুদিন আনসার কমান্ডার হিসেবে চাকরি করার পর ১৯৪৩ সালে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা শেখানো শুরু করেন। একটি শিশুকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করার জন্য তখন থেকেই তিনি নাচ, গান, অভিনয়, পিটি ও আরবি শিক্ষাসহ বিভিন্ন শিক্ষা দিতে থাকেন। দীর্ঘদিন তিনি একাই এ স্কুলের শিক্ষকতা করে আসছেন বলে জানান। বর্তমানে তার শরীরের যে অবস্থা তাতে যে কেনো দিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারেন। কিন্তু তিনি চলে গেলে এ স্কুলটির অবস্থা কি হবে তাই ভেবে তিনি দিশেহারা। এ কথাগুলো বলছিলেন আর ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে নীরবে তাকিয়ে ছিলেন স্কুলটির দিকে।
অসাধারণ এ মহৎ মনের মানুষটি এ বয়সেও একমাত্র ভাবনা কেবল ওই পাঠশালা আর এলাকার ঝরে পড়া ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যতৎ নিয়ে। যে মানুষটি মানুষিক তৃপ্তি ও নৈতিক দায়িত্বের কারণে নিঃস্বার্থভাবে এলাকার ঝরে পড়া ছেলে-মেয়েদের বাড়ি থেকে ধরে এনে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, তাদের অনেকেই আজ সমাজের উঁচু স্থানে অবস্থান করছেন। তাদের কী কোনো দায়িত্ব নেই মহান এ মানুষটি প্রতি? যে পাঠশালাটি সকাল ৮টা বাজার সাথে সাথে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের হৈ-হুল্লোড়ে মুখরিত হয়ে উঠে। সেই আব্দুল মালেক হাওলাদারের জরাজীর্ণ পাঠশালার প্রতি।
প্রতিদিন বুড়ো বটগাছের নিচে সারিবদ্ধ  হয়ে দাঁড়িয়ে ওরা পাঠ করে জাতীয় সংগীত। সেই সাথে পাঠ করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশ গড়ার শপথ। এরপর শুরু হয় জীর্ণ ঘরের খোলা বারান্দায় ক্লাস। এক হাত উঁচু কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি লম্বা বেঞ্চের মতো পাতানো অংশে বই ও খাতা রেখে কাঠ বা ইটের উপর বসে ক্লাস করে ছাত্র-ছাত্রীরা। ছাত্র-ছাত্রীদের মতো স্যারের জন্য রয়েছে জীর্ণ একটি নড়বড়ে চেয়ার। ভেঙে পড়ার ভয়ে ঘরের খুঁটির সাথে দড়ি দিয়ে চেয়ারটি শক্ত করে বাঁধা। লেখার ব্ল্যাকবোর্ডটিও অনেক পুরোনো। কিছু অংশ ভেঙেও গেছে তার। তবুও ছাত্র-ছাত্রীর কমতি নেই এ পাঠশালায়। ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় ৪০ জন ছাত্র-ছাত্রী। ৫টি গ্রুপে একই রুমে আলাদা আলাদাভাবে বসে ক্লাস করে তারা। প্রত্যেক ক্লাসে রয়েছে ১ জন করে দলনেতা। এ হচ্ছে আব্দুল মালেক হাওলাদারের পাঠশালা। সরেজমিনে গিয়ে এ সবই চোখে পড়বে সবার।
দীর্ঘ ৬৭ বছর ধরেই এমনিভাবেই দেখে আসছে এলাকাবাসী। প্রায় শতবর্ষী আব্দুল মালেক হাওলাদারের বার্ধক্য আসলেও মানুষ গড়ার কাজে থেমে থাকেননি তিনি। হাজারও সমস্যার মধ্যে তিনি একাই এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য যুদ্ধ করে চলেছেন দৃঢ়চেতা এ লোকটি। বৃষ্টি নামলেই বারান্দার টিনের বড় বড় ছিদ্র দিয়ে পড়ে বৃষ্টির পানি। তবুও বন্ধ হয় না ক্লাস। নিজ বাড়ি থেকে স্কুলটির দূরত্ব বেশি হওয়ায় প্রতিদিন তাকে বাসে বা ভ্যানগাড়িতে করে অনেক কষ্টে জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে আসতে হয় স্কুলে। হাঁটতে চলতে সমস্যা থাকার পরও স্কুল বন্ধ রাখেন না আত্মপ্রত্যয়ী এ মানুষটি। এ তো জীবন যুদ্ধ জয়ী এক অকুতোভয় সেনাপতির গল্পগাথা। যার বলিষ্ষ্ঠ নেতৃত্বে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন ঝরে পড়া অনেক সৈনিক। যারা আজ অধিষ্ঠিত সমাজের উঁচু উঁচু স্থানে।
এলাকাবাসী জানান, মাদারীপুর সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিঠাপুর বাজারে ১৯৪৩ সালে নিজস্ব উদ্যোগে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন আব্দুল মালেক। যা পরবর্তীতে খ্যাতি পায় ‘আব্দুল মালেক হাওলাদারের পাঠশালা’ নামে। এখানে তিনি বিনা বেতনে নিঃস্বার্থভাবে গ্রামের দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। যারা পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তাদেরকে অভিনব কৌশলে লেখাপড়ায় আগ্রহী করে তোলেন তিনি। লেখাপড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন সাংস্কৃতির ও শরীর চর্চা করিয়ে প্রতিটি ছাত্র-ছত্রীকে সার্বিকভাবে স্বাবলম্বী হতে প্রবল মানসিক শক্তি যোগান তিনি। যার অবদান বিনম্র শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এলাকাবাসী।
(শীর্ষ নিউজ ডটকম/এএসএ/এনডিএস/শাসি/আরআর/১৬:৪১ ঘ.)

Leave a comment