একজন আবুল কাশেম

নাটোর প্রতিনিধি: নাটোরে যাদের ঘরে ঈদ আসে না এমন অসহায় দরিদ্র ১০ হাজার মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন একজন আবুল কাশেম। নাটোর শহরতলির দত্তপাড়া এলাকার প্রচারবিমুখ এই মানুষটি নীরবে নিভৃতে জেলার হাজারো মানুষের কল্যাণে চালিয়ে যাচ্ছেন তার নানা কর্মকাণ্ড। সবার সহযোগিতা পেলে তিনি ভবিষ্যতে নাটোরে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গড়ে তুলতে চান। জানা গেছে, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে প্রথমে কিছুদিন চাকরি করে পরে ব্যবসা শুরু করেন। শিল্পপতি আবুল কাশেম নিজে অর্থশালী হওয়ার পর থেকেই নিজের জেলার মানুষের বেকারত্ব ও অভাব দূর করতে নানা পদক্ষেপ নেন। তবে কখনও এসব পদক্ষেপ তিনি প্রচারের চেষ্টা করেননি। এবারের ঈদে তিনি নিজে এবং নাটোর সদর উপজেলার ১২ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সব ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে নাটোরে যাদের ঘরে ঈদ আসে না এমন অসহায় দরিদ্র ১০ হাজার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তাদের উন্নত মানের ১০ হাজার শাড়ি লুঙ্গি দিয়েছেন। তিনি নাটোরে খামারবাড়ি ও গাজীপুরে শিল্প কারখানা স্থাপন করে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এর আগে তিনি এলাকার দুইশ’ যুবককে বেকারত্ব ঘোচাতে নিজের খরচে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছেন। তারা সবাই বর্তমানে মালয়েশিয়া থেকে পরিবার ও দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া একই সময়ে তিনি নাটোর সদর উপজেলার দুইশ’ অতি গরিব দুস্থ অসহায় মানুষকে সাবলম্বী করতে প্রত্যেককে এককালীন ১০ হাজার করে টাকা অনুদান দিয়েছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত শতাধিক কৃষককে তিনি হালের বলদ কিনে দিয়েছেন। তিনি এলাকার অভাবী অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে নীরবে নিভৃতে চালিয়ে যাচ্ছেন তার সংগ্রাম। ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারে চারটি আবাসিক মাদরাসাকে কয়েক বছর যাবৎ তিনি প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন মসজিদের উন্নয়নেও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। শুক্রবার আট হাজার মানুষের সুশৃঙ্খল বিশাল ইফতার মাহফিলে তিনি এবার এসব শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন। নাটোর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ, নাটোর চেম্বার অব কমার্স ও নাটোর প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবদুল মান্নাফ ও নাটোর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি শহিদুল ইসলাম বাচ্চুসহ এলাকার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আবুল কাশেমের দেয়া শাড়ি ও লুঙ্গি পেয়ে দত্তপাড়া এলাকার বৃদ্ধা আম্বিয়া বেগম ও বড়াইগ্রামের বৃদ্ধ রইস আলী বলেন, ‘বাবা জীবনে মেম্বার চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে কিছু পাইনি। এই বাবাজী দিয়েছে, আল্লাহ তার ভালো করুক।’ বিনা খরচে মালয়েশিয়া যাওয়া দত্তপাড়া গ্রামের আবুল হোসেনের পিতা আমিন উদ্দিন ও ইসলাবাড়ী  গ্রামের তাহের মিয়ার পিতা সমির মিয়া বলেন, ‘বাবা অভাবের সংসারে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতেই পেতাম না। সেখানে নিজে টাকা দিয়ে ছেলেকে মালয়েশিয়া পাঠাবো এমন সাধ্য আমার ছিল না। কাশেম বাবাজী বিনা খরচে আমার ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে আমার অভাবের সংসারে সুখ এনে দিয়েছে।’ আবুল কাশেমের এসব কর্মকাণ্ডে এলাকায় চলা নানা জল্পনা কল্পনা  সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার মনে এখনও কোন রাজনৈতিক অভিলাষ জন্ম নেয়নি। তিনি তার সাধ্যমতো এলাকার অতিদরিদ্র অভাবী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চান। সবার সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে নাটোরে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

http://www.mzamin.com/details.php?nid=MTgwMjI=&ty=MA==&s=MTk=&c=MQ==

জাহেদুরের বৃক্ষপ্রেম

দৈনিক ইত্তেফাক : ১২/০৮/২০১২

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার সোনাডাঙ্গা গ্রামের বৃক্ষপ্রেমিক জাহেদুর রহমান ইকবাল। ছাত্র জীবন থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চলের গাছপালা ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করতেন। সেই সাথে বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশবান্ধব বনায়নে শত শত কৃষক পরিবার ও জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করছেন তিনি।

রাজশাহী অঞ্চলকে মরুভূমির হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যাপক বনায়ন প্রয়োজন। একথা ভেবেই নিজ খরচে যেখানেই সুযোগ পান সেখানেই গাছ লাগান জাহেদুর। রাজশাহীর বাগমারা, মোহনপুর ও নওগাঁর আত্রাই উপজেলায় এক লাখ ১০ হাজার স্কয়ার ফিট দেয়াল লিখন, স্থানীয় পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রদান ছাড়াও গেঞ্জি, দেয়াল ঘড়ি ও ক্যালেন্ডার জনসাধারণের মাঝে বিতরণ করে বনায়নের জন্য প্রচারণা চালিয়ে আসছেন তিনি ।

১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি নিজ খরচে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার বৃক্ষরোপণ করেছেন। রাজশাহী ও নওগাঁ জেলার বিভিন্ন উপজেলার দুই শতাধিক সরকারি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮০টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শতাধিক কলেজ ও মাদ্রাসাসহ আরো অর্ধশতাধিক হাট, বাজার, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, গোরস্থান ও ঈদগাহ ময়দানে নিজস্ব উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করেন। চলতি মৌসুমে তিনি এক লাখ বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যেই চারা সংগ্রহ ও বৃক্ষ রোপণের কাজ চলছে। এরই মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৯ প্রজাতির ফলজ, বনজ, ঔষধি ও ফুলজাতীয় গাছের চারা রোপণের কাজ শেষ হয়েছে। স্থানীয়ভাবে জাহেদুর ‘বনবন্ধু’ খেতাব পেয়েছেন। এলাকায় তিনি বনবন্ধু জাহেদুর নামেই পরিচিত।

পুষ্টি বাড়ির গল্প

গ্রামের নাম চাঁনপুর। এ গ্রামের আদর্শ কৃষক মোঃ শহর আলী। প্রায় দু’একর জমি নিয়ে শহর আলীর বাড়ি। সবুজ পাছপালায় ঘেরা সুদৃশ্য এ বাড়িটি দেখলে যেকোনো মানুষেরই চোখ জুড়িয়ে যায়। ওই এলাকায় বাড়িটি ‘পুষ্টিবাড়ি’ নামে পরিচিত।

 

বাড়িটিতে রয়েছে ৫টি দুধের গাভী, ৪০০ হাঁস-মুরগির একটি খামার। এক বিঘা জায়গার উপর কাটা পুকুরে রয়েছে নানা রকম মাছ। আর বসতবাড়ির অঙিনায় চাষ হয় বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি। এ বাড়িতে আরো আছে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, সফেদা, বেল, নারকেল, কলা, পেঁপে, লেবু, পেয়ারা, কুল ফলের সমন্বয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন ফলের বাগান।

 

স্ত্রী রাজিয়া বেগম আর দু’ছেলে এক মেয়ে নিয়ে শহর আলীর সুখের সংসার। পরিবারের চাহিদা মেটে বাড়িতে উৎপাদিত এই সব টাটকা জিনিসে। সারা বছরই তার বাড়িতে পাওয়া যায় গরুর দুধ, হাঁস-মুরগির ডিম, মাছ, মাংস, শাকসবজি ও ফলমূল।

 

নিজের গ্রাম ছাড়া পাশের গ্রামের মানুষ শহর আলীর বাড়ির গরুর দুধ, হাঁস-মুরগির ডিম ও হাঁস-মুরগি, পুকুরের মাছ এবং বসতবাড়ির আঙিনায় উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূল কিনে নেন। এছাড়া স্থানীয় বাজারেও তিনি বসতবাড়ির কৃষিপণ্য বিক্রয় করেন। এর থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে শহর আলী সংসার চালান। তার ছেলেমেয়েরা সবাই লেখাপড়া করে। আর অবসর সময়ে বাবা মাকে বসতবাড়ির খামারের কাজে সাহায্য করে। শাকসবজি ও ফল বাগানে পানি সেচের জন্য শহর আলীর বাড়িতে পুকুর ছাড়াও রয়েছে ২টি টিউবওয়েল। বাগানে পানি সেচ ছাড়াও তিনি খাওয়া গৃহস্থালীর সব কাজে টিউবওয়েলের আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করেন।

 

শহর আলী ও তার স্ত্রী রাজিয়া বেগম জানান, তারা গৃহস্থালীর প্রতিদিনের আবর্জনা যেখানে সেখানে না ফেলে বসতবাড়ির সামান্য একটু দূরে গো-শালার কাছে এবং বাড়ির পেছন দিকে ছায়াযুক্ত স্থানে গর্ত করে আদর্শ পদ্ধতিতে জৈব সার তৈরি করেন যা তারা ফলমূল ও শাকসবজি বাগানে ব্যবহার করেন। যার কারণে সবজি উৎপাদনে তাদের খরচ হয় কম।

 

গ্রামের দেশ বাংলাদেশ। এদেশের গ্রামগঞ্জে প্রায় দেড় কোটি বসতবাড়ি রয়েছে। বসতবাড়ির জমি সাধারণত উঁচু ও স্থায়ী হওয়ায় তা কৃষি খামারে রূপান্তরের জন্য একটি উপযোগী স্থান। তাই নারী, পুরুষ, ছেলেমেয়ে সবার চেষ্টায় দেশের প্রত্যেক বসতবাড়িকে পরিকল্পিতভাবে আদর্শ চাষি শহর আলীর মত ‘পুষ্টি বাড়ি’ তৈরির মাধ্যমে একটি পরিবার খুব সহজেই প্রতিদিনের পুষ্টি চাহিদা পূরণের সাথে সাথে আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করতে পারেন, যা দেশের পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়ন ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিবাচক অবদান রাখতে সহায়ক হবে।

পতিত জমিতে সবজি চাষে সুনিল-অলির চমক

মরান হাসান সোহেল, পটুয়াখালী
সুনিল চন্দ্র সিকদার ও মো. অলি কারিগর। সুনিল পয়ষট্টিতে পেঁৗছেছেন। আর অলি ত্রিশ বছরের যুবক। বয়সের বাধা পেরিয়ে তাঁরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গড়েছেন নতুন অধ্যায়। কঠোর পরিশ্রম দিয়ে পতিত জমিতে নজরকাড়া সবজি চাষ করে পটুয়াখালীতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। উভয়েই কৃষক পরিবারের সন্তান। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তাঁদের সে পরিচয় ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। অভাবগ্রস্ত সুনিল ও অলি পৈতৃক কৃষি পেশার পুরনো ঐতিহ্যকে জেগে তুলেছেন সবজি চাষে। নানা জাতের সবজি চাষ করে এখন আদর্শ কৃষক হিসেবে নিজেদের পরিচয় নতুনভাবে গড়েছেন। সেই সবজি বিক্রি করে দুই হাতে আয় করছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। পতিত জমিতে তাঁদের দৃষ্টিনন্দন সবজি উৎপাদনের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই এসে ঘুরে দেখছেন বাগান।
বরিশাল বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণের অতিরিক্ত পরিচালক মো. শাহ আলম এবং পটুয়াখালী জেলা খামারবাড়ির উপপরিচালক নিখিল রঞ্জন মণ্ডল বলেন, পতিত জমির সবজি বাগান দেখে উচ্ছ্বসিত না হয়ে থাকা যায় না।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কনকদিয়া ইউনিয়নের দ্বিপাশা গ্রামের আদি বাসিন্দা সুনিল এবং অলি। তাঁদের বাড়ি দ্বিপাশা-বীরপাশা রাস্তার মাঝামাঝি স্থানে। আর ওই রাস্তার দুই পাশজুড়ে পতিত জমিতে গড়ে তুলেছেন টমেটো, করলা, বেগুন, শালগম, শসা, লাউ, চিচিঙ্গা, ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং মরিচসহ নানা জাতের সবজির বাগান। যেকোনো আগন্তুক ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ফলন্ত সবজিবাগান দেখে থমকে দাঁড়ান। কারণ ওই রাস্তার পাশের পতিত জমিগুলো বরাবরই ছিল অযত্নে-অনাবাদি। সেই জমিতে এখন শোভা পাচ্ছে নানা জাতের সবজির গাছ। আর গাছে ঝুলে আছে হরেক রকম সবজি। এমন দৃশ্য পথিককে থামিয়ে চোখ বোলাতে বাধ্য করে। শুধু রাস্তার পাশের পতিত জমিই নয়, চাষের আওতায় নেওয়া হয়েছে ধান ক্ষেতের আইল এবং আশপাশের সব পরিত্যক্ত ভিটে এবং পুকুরপাড়। দুজনে প্রায় সাড়ে ৪ একর পতিত জমিতে সবজি ফলিয়েছেন।
জানা যায়, স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রান্তিক কৃষকসহ বেকার যুবকদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধকরণ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪০০ কৃষককে প্রশিক্ষণসহ পরামর্শ প্রদান করেন। এদের মধ্যে ১১০টি সবজি খামার গড়েছেন কৃষকরা। তবে তাঁরা সবাই চাষের জন্য বেছে নিয়েছেন আবাদি জমি। কিন্তু পতিত জমিতে ব্যতিক্রম এ উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছেন সুনিল ও অলি। প্রতিদিন তাঁদের বাগানের সবজি যায় স্থানীয় বগা, বাহেরচর, কালিশুরী, কাছিপাড়া, নুরাইনপুর, কনকদিয়া, বীরপাশা, বাউফল, পাড়েরহাট, আয়লা ও বিলবিলাস বাজারে। এরই মধ্যে এসব বাগান থেকে সবজি বিক্রি করেছেন প্রায় এক লাখ টাকার। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে চলমান প্রকল্প থেকে আরো তিন লাখ টাকার অধিক সবজি বিক্রির সম্ভাবনার কথা জানান তাঁরা। অথচ ছয় মাস আগেও অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে সংসার চালিয়েছেন সুনিল ও অলি। এখন তাঁরা বেশ খুশি। তবে অনুযোগও রয়েছে। সবজি চাষে অর্থের জোগান পেয়েছেন উচ্চ সুদে বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে। এ কারণে লাভের একটা বড় অংশ দিয়ে পরিশোধ করতে হয় ঋণের টাকা। তাই এ উদ্যোগের ব্যাপক প্রতিফলনের জন্য সাধারণ কৃষককে সরকারি ব্যাংক থেকে জমির নিরাপত্তা ছাড়া স্বল্প সুদে ঋণের দাবি তাঁদের।
সুনিল চন্দ্র সিকদার বলেন, ‘চিন্তাও করি নাই এত ভালো ফলন অইবে। বাবা, এহন বাগানের দিগে চাইলে পরানডা জুড়াইয়া যায়। সরকার যদি আমাগো মোত গরিবেরে কোম সুদে লোনের ব্যবস্থা কইর‌্যা দেতে, তাহেলে অনেক মানুষ সবজি ফলাইতে, অভাব কোমতে গ্রামের মাইনস্যের।’
মো. অলি কারিগর বলেন, ‘আমাগো সবজি দেইক্যা সবাই আমাগো সুনাম কয়, ভালো টাহাও পাই বেইচ্যা, সংসারে অভাবও নাই, কিন্তু লোনের লইগ্যা সুদে লইয়া যায় ব্যামালা টাহা’।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, পটুয়াখালীর উপপরিচালক নিখিল রঞ্জন মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষ এবং প্রান্তিক চাষিদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে অনাবাদি থাকা পতিত জমি চাষের আওতায় নেওয়া গেলে অনেকেই সুনিল এবং অলির মতো উদাহরণ সৃষ্টিকারী হতে পারত। গ্রামাঞ্চলে অভাবী মানুষের সংখ্যা কমে যেত। এ ছাড়া সবজির দামও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে আসত। সুনিল-অলি কৃষি সেক্টরে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত’।

দিনমজুর রহমত আলীর বিনা চাষে রসুন উৎপাদন

নাটোরে চাষ ছাড়াই রসুন উৎপাদন* বছরে আয় দুই হাজার কোটি টাকা
* পদ্ধতির উদ্ভাবক কৃষক নিজেই রেজাউল করিম রেজা, নাটোর

চাষের জন্য জমি তৈরি করা ছাড়াই বেড়ে উঠবে ফসল, বছরে আয়ও হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। বিষয়টি অবাস্তব মনে হলেও তা সম্ভব করেছেন নাটোরের কৃষকরা। নিজেরাই বদলেছেন নিজেদের ভাগ্য।
১৯৯৫-১৯৯৬ সালের কথা। নাটোরের বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার কৃষকরা প্রাথমিকভাবে চলনবিলের কাদামাটিতে রসুনের বীজ রোপণ করেন। কোনোরকম চাষ ছাড়াই বেড়ে ওঠে রোপিত রসুন। আবাদে পরিচর্যা খরচ না থাকায় বীজের খরচ ছাড়া পুরোটাই লাভ। তাই এলাকাবাসী এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত চাষ পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ‘বিনা চাষে রসুন উৎপাদন’।
চাষের সময় ও চাষ উৎপাদন পদ্ধতি : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে চলনবিলের পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নরম কাদামাটিতে রসুনের বীজ রোপণ করা হয়। দো-আঁশ, এঁটেল-দোআঁশ ও পানি জমে না এমন জমি এ পদ্ধতির রসুন চাষের জন্য উপযুক্ত।
তিনি জানান, নভেম্বরের মধ্যে আমন ধান কাটার পর জমির আগাছা দ্রুত পরিষ্কার করে মাটি নরম থাকতেই প্রতি বিঘা জমিতে ৩০ কেজি টিএসপি, ২৫ কেজি পটাশ এবং ১৫ কেজি হারে জিপসাম সার ছিটানোর দুই-একদিনের মধ্যেই জমিতে সারিবদ্ধভাবে রসুন বীজ রোপণ করতে হবে। রোপণের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় দুই মণ বীজ প্রয়োজন হয়। প্রতি বিঘা জমি রোপণ করে ওই দিনই খড় বা বিচালি দিয়ে জমি ঢেকে দিতে হয়।
বীজ রোপণের এক মাস পর পানি সেচ দিয়ে বিঘায় ১০ কেজি হারে ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিতে হয়। ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। এই পদ্ধতির রসুন চাষে রোগ-বালাই খুব কম। বিঘাপ্রতি ফলন হয় ১৫ থেকে ২৫ মণ পর্যন্ত।
দেলোয়ার জানান, কৃষকদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের কারণে উত্তর-পশ্চিম শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পে (এনসিডিপি) এই শস্যটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। চলতি মৌসুমে এ প্রকল্পে রসুনের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন বিষয়ে জেলার এক হাজার ২০০ কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, শুধু রসুন চাষের জন্য জিডিপিতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা সংযোজিত হচ্ছে। এ কারণে লাভজনক এ চাষ পদ্ধতিটি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
উদ্ভাবকদের কথা : বড়াইগ্রাম উপজেলার চকপাড়া গ্রামের দিনমজুর রহমত আলী, মামুদপুরের ভ্যানচালক মোবারক ও মকদম হোসেন, গুরুদাসপুরের আবদুর রহিম ও শ্যামল, কাছিকাটার আবদুল কুদ্দুস, বাজিতপুরের ভোলা মণ্ডলের ছেলে মোজাহার ও সাজদার রহমানসহ এলাকার হাজার হাজার ভূমিহীন, গরিব দিনমজুর, শ্রমিক, নিম্নআয়ের মানুষগুলো এই চাষের উদ্ভাবক। তাঁরা নিজেদের উৎপাদিত নতুন পদ্ধতিতে রসুন চাষ করে নিজেরাই এখন স্বাবলম্বী।
কয়েকজন কৃষক জানান, যাঁদের বসবাসের ঘর ছিল না, তাঁরাও এখন পাকা ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন। বাড়িতে দিয়েছেন টিউবওয়েল, স্যানিটারি ল্যাট্রিন, সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন। ভূমিহীন এসব মানুষ ২০-৩০ হাজার টাকা করে জমি লিজ নিয়ে প্রতিবছর বিনা চাষে রসুনের আবাদ করছেন।
রসুন চাষি ও বাজিতপুর গ্রামের কলেজ শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন জানান, এক বিঘা জমিতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। গতবার প্রতি মণ রসুন বিক্রি হয়েছে চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। গতবারের মতো এবারও দাম থাকলে প্রতি বিঘায় কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা মুনাফা পাবে কৃষকরা। তাঁর মতে, মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত নবান্নের আনন্দ উৎসবের মতোই এলাকার মানুষ রসুন ঘরে তোলে। বিনা চাষে রসুন চাষ এলাকার হাজার হাজার মানুষকে করেছে স্বাবলম্বী। এলাকায় ঘটছে নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরলেও চাষ হয়েছে ১৫ হাজার ১২৫ হেক্টর জমি। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন। অথচ ২০০৩-০৪ মৌসুমেও নাটোরে মাত্র তিন হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে রসুন চাষ হয়।

জাহিদের মাছ চাষের নতুন দিগন্ত উন্মোচন

অতি বর্ধনশীল চীনের ব্ল্যাককার্প মাছের দেশি পদ্ধতিতে প্রজনন ঘটিয়ে যশোরের চাঁচড়া গ্রামের জাহিদুর রহমান জাহিদ মাছ চাষের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। এখন তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেশের বিভিন্ন হ্যাচারিতে ব্ল্যাককার্পের রেণু উৎপাদন হচ্ছে। এক বছরেই এই রেণুপোনা শামুকসহ নানা খাদ্য গ্রহণ করে ৭-৮ কেজির একটি বড় মাছে পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এই মাছের আগমন ঘটে ১৯৯০ সালের দিকে। জার্মান, জাপান, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের উন্নতমানের হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করেও খুব ভালো ফল পায়নি বিশেষজ্ঞরা। পরে যশোরের মাতৃ ফিশ হ্যাচারির মালিক জাহিদ ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো দেশি হরমোন প্রয়োগ করে ব্ল্যাককার্পের প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হন। এর পর উৎপাদন হয় লাখ লাখ পোনা। যা দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষ হচ্ছে। বর্তমানে জাহিদের ২০-২৫ কেজি ওজনের ৫০টির মতো ব্ল্যাককার্পের ‘মা মাছ’ রয়েছে।

http://www.dailykalerkantho.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=29-01-2011&type=gold&data=Cricket&pub_no=415&cat_id=1&menu_id=84&news_type_id=1&index=6

বিএ অনার্সের ছাত্রী রিতার মাশরুম বিপ্লব

ফখরে আলম, যশোর

পুষ্টিকর সুস্বাদু সবজি মাশরুম চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছে যশোরের শত শত বেকার ছেলেমেয়ে। মাসে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করে অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রকল্পের আওতায় যশোরের বিরামপুর গ্রামে গড়ে উঠেছে মাশরুম পল্লী। চাহিদা মেটাতে যশোরের হর্টিকালচার সেন্টারে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মাশরুম গবেষণাগার। যেখানে প্রতিমাসে সাত হাজার প্যাকেট বীজ উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার জনকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যশোরে এখন তাজা মাশরুমের পাশাপাশি শুকনো ও গুঁড়ো মাশরুমের রান্না করা খাবারও বিক্রি হচ্ছে।
মাশরুম কী : গ্রামের মানুষের কাছে মাশরুম ব্যাঙের ছাতা বলেই পরিচিত। বাস্তবে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত বীজের মৃতজীবী ছত্রাক হচ্ছে মাশরুম। যা সুস্বাদু, পুষ্টিকর, ওষুধিগুণসম্পন্ন শতভাগ হালাল সবজি। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে মাশরুমকে অত্যন্ত মর্যাদাকর খাবার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মাশরুমের গুণাগুণ : মাংসে ১৭ ভাগ, ডিমে ১৩ ভাগ প্রোটিন থাকলেও মাশরুমে প্রোটিনের পরিমাণ ২৫-৩৫ ভাগ। ১০০ গ্রাম শুকনো মাশরুমে ২৫-৩৫ ভাগ আমিষ, ৫৭-৬০ ভাগ মিনারেল, ছয়-সাত ভাগ শর্করা, চার-ছয় ভাগ চর্বি রয়েছে। মাশরুম ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগ নিরাময়ে অতুলনীয়। কীটনাশকমুক্ত বলে এই সবজি স্বাস্থ্যসম্মত। মাটি ছাড়া অল্প জায়গায় মাশরুম চাষ করা যায়।
ভাজি, স্যুপ, খিচুড়ি, সবজি, মাছ ও মাংসের সঙ্গে রান্না ছাড়াও মাশরুম বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়। এ ছাড়া মাশরুম শুকিয়ে গুঁড়া করে চা, শরবত, কফি, পানির সঙ্গে খাওয়া যেতে পারে। বর্তমানে কাঁচা মাশরুম প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, শুকনো গুঁড়ো মাশরুম প্রতি কেজি এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চাষ পদ্ধতি : আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ওয়েস্টার মাশরুম চাষ হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে কাঠের গুঁড়ো, গমের ভুষি, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, পানির মিশ্রণে স্পন তৈরি করা হয়। স্পন একটি পলিথিন প্যাকেটে থাকে। এই প্যাকেটের দুই দিকে ইংরেজি ডি (উ)-এর আকারে কেটে তা কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এর পর সারিবদ্ধভাবে প্যাকেট খালি চোখে খবরের কাগজ পড়া যায় এমন আলোময় জায়গায় রেখে প্রতিদিন সকাল-বিকেল হালকা করে পানি স্প্র্রে করতে হবে। দু-চার দিনের মধ্যে মাশরুমের অঙ্কুর বের হবে। সাত দিনের মধ্যে পরিপূর্ণ মাশরুম পাওয়া যাবে। এভাবে এক প্যাকেট থেকে পর্যায়ক্রমে তিন মাস মাশরুম পাওয়া যায়। যশোর হর্টিকালচার সেন্টারে প্রতি প্যাকেট স্পন বিক্রি হচ্ছে আট টাকায়।
কৃষি মন্ত্রণালয় মাশরুম উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের অধীন দেশের ১৬টি উপকেন্দ্রে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
যশোর হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ মাশরুম চাষের সমন্বয়কারী আমিনুল ইসলাম জানান, যশোরে পাঁচ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিরামপুর গ্রামে ৩০ জন চাষিকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে মাশরুম পল্লী। তিনি আরো জানান, বর্তমানে যশোরে সহস্রাধিক চাষি মাশরুম চাষের সঙ্গে যুক্ত।
মুড়লি এলাকার আইয়ুব হোসেন ‘আশা মাশরুম’, ডালমিল এলাকার তৌহিদুল ইসলাম ‘রাজিয়া মাশরুম’, খড়কি এলাকার তামান্না ‘জীবন সংগ্রাম মাশরুম’ নামের ফার্ম গড়ে তুলে প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা আয় করছেন।
সরেজমিন বিরামপুর মাশরুম পল্লীতে খবর নিয়ে জানা যায়, বিএ অনার্সের ছাত্রী রিতা রায় লেখাপড়ার পাশাপাশি মাশরুম চাষ করে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাচ্ছেন। তাঁর ৮০ প্যাকেট মাশরুম রয়েছে। এখান থেকে তিনি প্রতিমাসে দুই হাজার টাকা আয় করেন। রিতা বলেন, ‘আমি শিক্ষকের ৪০০ টাকা বেতন দিচ্ছি। বই-খাতার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও কিনছি।’

বিলের বাঁধে রিপন আলীর হাঁসের খামার

বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার রক্তদহ বিলের বাঁধ এখন হাঁসের খামারে পরিণত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে বেকার যুবকরা এসে বিলের বাঁধে গড়ে তুলেছেন একাধিক হাঁসের খামার। এদের মধ্যে রিপন আলীর হাঁসের খামার সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। বর্তমানে তার খামারে হাঁসের সংখ্যা প্রায় ৫ থেকে ৬শ’।

রিপন আলী। বাড়ি বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলার পাতাঞ্জু গ্রামে। বেকার ছিলেন। মানুষের নানান কথা আর খারাপ ব্যবহারে মন যখন ভারাক্রান্ত তখন মাথায় আসে রক্তদহ বিলের বাঁধে হাঁসের খামারের কথা। সামান্য কিছু পুঁজি নিয়ে নেমে পড়েন তিনি। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রমাণ করেছেন ইচ্ছে থাকলে উপায় একটা হয়-ই হয়। তার সফলতা দেখে এখন এলাকার অনেক বেকার যুবক এগিয়ে এসেছেন রক্তদহ বিলের বাঁধে হাঁসের খামার করতে।

মাত্র ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে এ পদ্ধতিতে হাঁসের খামার করে অভাবনীয় সফলতা পেয়ে যান রিপন। হাঁসের খামার থেকে আসা লাভের টাকা দিয়ে নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন হাঁসের হ্যাচারি। নিজের হ্যাচারিতে তিনি এখন তুষ পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন করছেন। পাশাপাশি সেই বাচ্চা অন্য খামারিদের কাছে বিক্রি করে হচ্ছেন লাভবান। রিপন জানান, অনেকদিন ধরেই হাঁসের খামারের কথা তার মাথায় ঘুরপাক খেলেও তাদের বাড়ি বিল এলাকায় না হওয়ায় হাঁসের খামার গড়ে তুলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। একদিন পাশর্্ববর্তী নওগাঁ জেলার আত্রাই হাটে গিয়ে খোলা জলাশয়ে বিলের বাঁধে হাঁস পালন করা দেখে তার মধ্যে এই পদ্ধতিতে হাঁসের খামার করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। অনেক কষ্টে কিছু টাকা জোগাড় করে মাত্র ৫০টি হাঁস কিনে তিনি হাঁসের খামার শুরু করেন।

খোলা জলাশয়ে হাঁস পালন সমর্্পকে রিপন আরো জানান, সাধারণত খামারে আটকে রেখে হাঁস পালনে অনেক বেশি খরচ। খামারে ১টি হাঁসের জন্য যে পরিমাণ খরচ হয়, খোলা বিল এলাকায় সে খরচ অর্ধেকেরও কম হয়। কারণ বিলে হাঁস শামুকসহ নানা খাবার সহজেই পায়। বিলের খোলা জায়গার খাবার খাওয়ার জন্য হাঁস ডিমও দেয় অনেক বেশি। এ ছাড়া হাঁস রাখার জন্য কোনো ঘর তৈরি করতে হয় না। বাঁেধর উপর পলিথিন দিয়ে ঘিরে সামান্য খরচে হাঁস রাখার জায়গা তৈরি করতে হয়। খোলা বিলে ১টি হাঁসে জন্য খরচ হয় সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ১শ’ টাকা। ৪ থেকে ৫ মাস বয়স হলে হাঁস ডিম দেয়া শুরু করে। ক্যাম্বেল জাতের প্রতিটি হাঁস একটানা ২৫০ থেকে ২৮০টি পর্যন্ত ডিম দেয়।

বর্ষা মৌসুমের ৬ মাস রিপনের কাটে বিলের বাঁধে, বাকি সময় থাকে হ্যাচারি নিয়ে। হাঁসের ডিম দেয়া শেষ হলে হাঁস ও ডিম বিক্রি করে তার লাভ হয় ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা। রিপনকে অনুসরণ করে বর্তমানে রক্তদহ বিল এলাকার বাঁধে খামার করেছে জাকারিয়া, মোতালেব, রুহুল, জাকিরুলসহ ১০ জন বেকার যুবক। এদের প্রত্যেকের হাঁসের সংখ্যা ৩ থেকে ৪শ’র উপরে। হাঁস পালনকারী জাকারিয়া বলেন, লেখাপড়া শিখে চাকরির আশায় বসে না থেকে বেকার যুবকরা ছোটখাট হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলতে পারেন। বর্তমানে যারা বিলের বাঁধ থেকে হাঁসের খামার গড়ে তুলেছেন তারা সবাই কমবেশি লেখাপড়া জানেন।

খোলা জলাশয়ে হাঁস পালন সম্পর্কে আদমদীঘি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এনামুল হক রক্তদহ বিলের বাঁধে হাঁস পালন সম্পর্কে বলেন, বেকার যুবকদের এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তারা চাইলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এ ছাড়া তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেবে প্রাণিসম্পদ বিভাগ। তিনি আরো বলেন, হাঁসের যেকোনো ধরনের রোগ দেখা দেয়ার আগেই তার বিভাগের লোকজন বিল এলাকায় ওই সমস্ত খামারে গিয়ে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা করবে। এস. এম. নাজমুল হক ইমন, সান্তাহার, বগুড়া

http://www.ittefaq.com.bd/content/2011/01/30/news0928.htm

বায়োগ্যাস থেকে সিএনজি

বান্দরবানের খোকন দৃষ্টি কেড়েছেন সারাদেশের কৃষি উদ্যোক্তার

মাটি ও মানুষের কৃষি ডেস্ক

দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত বহুবার বায়োগ্যাস পস্ন্যান্ট স্থাপন ও কৃষকের লাভবান হওয়ার কথা আমরা পত্র-পত্রিকা কিংবা টিভির মাধ্যমে জানতে পেরেছি। অনেক ঝক্কি ঝামেলা পার হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা দেখতে পেরেছেন সফলতার মুখ। আপনারা দেখেছেন তিন বছর আগে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের শ্যামেরঘন গ্রামে আব্দুর রাজ্জাক সিএনজি চালিত জেনারেটরের মাধ্যমে মাঠে মাঠে সেচ সুবিধা পেঁৗছে দিতে। রায়গঞ্জ উপজেলা ছাড়িয়ে সিএনজি চালিত সেচ পাম্প পেঁৗছে যায় তাড়াশ উপজেলায়। অগভীর থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমেও চলতে থাকে সেচ সুবিধা পেঁৗছে দেয়ার কাজ। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের পটিয়ায় শিকলবাহার দুগ্ধপলস্নীর ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে বায়োগ্যাস পস্ন্যান্ট। গ্যাসের বিদু্যতে আলোকিত হচ্ছে এক একটি ঘর, মিটছে তাদের নিত্য দিনের জ্বালানি চাহিদা।

বায়োগ্যাস পস্ন্যান্ট থেকে জ্বালানি হয়, বড় জোর জ্বলে বাতি, খামার পর্যায়ে এ প্রযুক্তির বিকাশ ছিল একুটুই। বান্দরবানের খোকন দাসই প্রথম বায়োগ্যাসের আরো কার্যকর ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন। ইতিমধ্যে টেলিভিশন ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কল্যাণে তার এ সফলতা পেঁৗছে গেছে অনেক অনেক দূর। সারাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোক্তার দৃষ্টি এখন এমন লাভজনক উদ্যোগের দিকে। কারণ, আমাদের দেশে দিন দিন বাড়ছে জৈব সারের চাহিদা; সে সঙ্গে জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজনীয়তার কথা তো বলাই বাহুল্য। আছে বিদু্যতের চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে বায়োগ্যাস থেকে দেয়া বিদু্যতেরও।

খোকন দাস দরিদ্র পরিবারের সন্তান। লেখাপড়ায় প্রাথমিক শ্রেণীর গণ্ডি পেরোতে পারেননি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তার ভাবনায় গুরুত্ব পায় কৃষি। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা থেকে শুরু করে কীটনাশকের আগ্রাসন থেকে কৃষিকে বাঁচানোর জন্য চিন্তা-ভাবনা করে আসছেন অনেক আগে থেকেই। তার চিন্তায় ছিল উৎকৃষ্টমানের জৈব সার তৈরির বিষয়টি। এ চিন্তার পথ ধরেই একদিন পেঁৗছে যান বায়োগ্যাস পস্ন্যান্টের কাছে।

খোকন দাস করতে চেয়েছেন ব্যতিক্রম কিছু। তাই বায়োগ্যাস পস্ন্যান্টেই তিনি থেমে থাকেননি। পস্ন্যান্ট নিয়ে নতুন নতুন চিন্তা করেছেন রাত-দিন। দিনের পর দিন এঁকেছেন নতুন নতুন মানচিত্র। একদিন সূয়ালক এলাকায় ২একর পাহাড়ি জমির উপর গড়ে তোলা বায়োগ্যাস পস্ন্যান্টটির দিকে দৃষ্টি আনতে পেরেছেন সারা দেশবাসীর। খোকন তার বায়োগ্যাস পস্ন্যান্টের সঙ্গেই যুক্ত করেছেন গ্যাস জেনারেটর। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদু্যতের শক্তি দিয়ে বায়োগ্যাসকে তৈরি করেছেন রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসে। যাকে আমরা সিএনজি বলি।

দেশের লক্ষ লক্ষ যানবাহনের সবচেয়ে লাভজনক জ্বালানি সিএনজি। এখন প্রতিদিনই সিএনজি চালিত অটোরিক্সা আসে খোকনের এই পাম্প থেকে গ্যাস নিতে। এখানে ভাল মানের সিএনজি পাওয়াতে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন সিএনজি পরিবহনের চালকরা। খুব বেশি সিএনজির চাহিদা পূরণ সম্ভব হয় না ঠিকই কিন্তু এলাকাবাসী এখন বিশ্বাস করেছে যে এখান থেকে একদিন ঠিকই তাদের নানা ধরনের চাহিদা পূরণ হবে। কিন্তু মানুষের আশা বাড়িয়ে দেয়া এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন অনেক অনেক অর্থের।

বর্তমানে এই পস্ন্যান্টে মাত্র ৯টি গরু এবং কিছু হাঁস-মুরগি রয়েছে। কিন্তু পস্ন্যান্টের জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ কাঁচা গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা। এ কারণে জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গরুর গোবর এবং হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা সংগ্রহ করে বায়োগ্যাস পস্ন্যান্ট চালানো হচ্ছে। বর্তমানে বায়োগ্যাস পস্ন্যান্টে গ্যাসের চাপ প্রচুর। সার্বক্ষণিক গ্যাসের চাপ ধরে রাখতে প্রচুর পরিমাণে গরুর গোবর দরকার হলেও জেলায় প্রয়োজনীয় গরুর গোবর পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানালেন খোকন দাস। এখনো এই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে খোকন চিন্তা করেন বায়োগ্যাস পস্ন্যান্টের উচ্ছিষ্ট অংশের জৈব সারকে। পস্ন্যান্টের মধ্যেই তিনি তার পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী স্থাপন করেছেন জৈব সারের একটি কক্ষ। যেখানে জমা হয় উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার। এরও বাণিজ্যিক গুরুত্ব কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের জন্য কম নয়। খোকন দাসের এই প্রকল্পের সঙ্গে সবচেয়ে সহায়ক হিসেবে রয়েছেন এই এলাকারই যুবক নূরুল আমীন।

বান্দরবানের সূয়ালকে খোকন দাসের উদ্ভাবন ও প্রয়াস সাড়া জাগিয়েছে গোটা এলাকাসহ সারাদেশে। একটি উদ্ভাবন থেকে ছোটখাটো একটি ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়ে গেছে খোকন দাসের নিরলস পরিশ্রমে। সিএনজি পরিবহনের পাশাপাশি বাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য সিলিন্ডারেও গ্যাস নিতে আসেন অনেকেই। গ্যাসের মান নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। এখন স্বল্প উৎপাদনেই দৈনিক কমপক্ষে তিন সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি করেন খোকন দাস। যারা গ্যাস নিচ্ছেন তারাও আছেন বেশ স্বস্তিতে।

কৃষিকে লাভজনক করতে কিংবা জীবনের প্রাত্যহিক প্রয়োজনগুলো আরো সহজে মেটানোর জন্য তৃণমূলে চলছে বহু রকম গবেষণা। বিদু্যত, জ্বালানি আর জৈব সারের চিন্তা থেকেই বায়োগ্যাস, সেখান থেকেই সিএনজি। খোকন দাসের এই প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত এদেশে বহুমুখি উৎপাদন ব্যবস্থার একটি মডেল। দেশের অনেক উদ্যোগী কৃষক ও খামারিই ইতিমধ্যে স্থাপন করেছেন বিভিন্ন আকারের বায়োগ্যাস পস্ন্যান্ট। সেখান থেকে তারা মেটাচ্ছেন দৈনন্দিন বিদু্যত ও জ্বালানির চাহিদা। এবার সিএনজির চাহিদা পূরণের চিন্তা নিয়ে এমন এক একটি পস্ন্যান্ট স্থাপিত হতে পারে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সেক্ষেত্রে খোকন দাসের এই পস্ন্যান্টটিই হতে পারে অনুসরণীয়। তা একদিকে আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রতিদিনের চাহিদা পূরণে যেমন কিছু অংশের যোগানদার হতে পারে, অন্যদিকে জৈব সার উৎপাদনেও আমরা এগিয়ে যেতে পারি বেশ খানিকটা পথ।

http://www.ittefaq.com.bd/content/2011/01/30/news0925.htm

বিদেশ-ফেরত যুবকের সাফল্য

পঞ্চগড় জেলার ধাক্কামারা-আহমদনগর গ্রামের মোহাম্মদ আবুল আলা সেলিম বেশ কয়েক বছর মালয়েশিয়া থাকার পরও তেমন কিছু করতে পারেননি। তিনি দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় ভাবলেন, বিদেশে থেকে যেহেতু উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতার মুখ দেখছি না তাই বিদেশে না থেকে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে নিজস্ব জমিগুলোতে চাষাবাদে মনোনিবেশ করব। যেমন চিন্তা তেমনই কাজ। তিনি প্রথমে ভাবলেন, নিজ জমিতে পুকুর কেটে মৎস্য চাষ করবেন। কিন্তু এ জেলায় তো মাছ চাষ করা সম্ভব নয়। কারণ, বালু মাটির ফলে বর্ষা মৌসুম ছাড়া নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যায়। ফলে মাছ চাষ এখানে সুবিধাজনক নয়। কিভাবে সারা বছর মাছ চাষ করা যায় এ নিয়ে ভেবে মাছ চাষের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন তিনি। চার ফুট মাটি খুঁড়ে মোটা পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর হাফ ফুট মাটি দিয়ে মেশিনের সাহায্যে পানি দিয়ে পুকুর তৈরি করে মাছ চাষ করে জেলায় আলোড়ন সৃষ্টি করেন এ যুবক। মৎস্য চাষে সফলতার জন্য মৎস্য অধিদপ্তর পঞ্চগড় জেলা আয়োজিত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পান তিনি।
মাছ চাষে সাফল্যের পর এক বিঘা জমির ওপর আপেল কুলের চাষ শুরু করেন তিন বছর আগে। তিনি জানান, গত বছর কয়েকটি গাছে ফুল এলেও এবার সবকটি গাছেই ফল ধরেছে। এ বছর বিক্রি ভালো হবে বলে আশা করেন তিনি। বিদেশ-ফেরত সেলিমের সাফল্য দেখে এখন পঞ্চগড়ের অসংখ্য বেকার মাছসহ অন্যান্য কৃষি ফসল চাষে আগ্রহী হয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।
মাহমুদ আহমদ সুমন, পঞ্চগড়

http://www.kalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=Download&pub_no=408&cat_id=1&menu_id=84&news_type_id=1&index=6