কৃষির মাধ্যমে বিজনের ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’

এমরান হাসান সোহেল, পটুয়াখালী

‘প্রায় আট হাজার টাকা বেতনের বেসরকারি চাকরিতে কোনোভাবেই পরিবারের ব্যয় মিটছিল না। পরে চাকরি ছেড়ে দিই। বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করি ৭০ হাজার টাকা। যাত্রা শুরু করি কৃষি কাজের। ধানের পাশাপাশি মৎস্য ও সবজি চাষ এখন আমার অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়েছে। পরিবারের সচ্ছলতার সঙ্গে এখন জমিয়েছিও মোটা অঙ্কের অর্থ। অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্বাস করি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে চাষাবাদ করলে কৃষিতেই অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব।’ এসব কথা বলছিলেন পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বীরপাশা গ্রামের শিক্ষিত যুবক বিজন রায়।
বিজন জানান, ধান চাষের পাশাপাশি এক একর জমিতে মাছের ঘের তৈরি করেন। ঘেরের পাড়ে সবজি বাগান। আর ঘেরের পানিতে চাষ করেন কৈ মাছ। ৬০ হাজার কৈ। দুই মাস ২০ দিন ব্যবধানে শুরু হয় মাছ বিক্রি। গত ছয় মাসেই বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার কৈ। আর এক লাখ টাকার সবজি। বর্তমানে পুকুরে কৈ মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে সিলবার কার্প, রুই, কাতলা, বিগহেড, মনোসেঙ্ তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ। ঘেরের পাড়ে চলছে ফুলকপি, বেগুন, শসা, করলা, লাউসহ বিভিন্ন সবজি চাষ।
জানালেন, নিজের হাতেই পরিচর্যার কথা। সঙ্গে রাখেন আরো একজন শ্রমিক। বললেন, তার সাফল্য দেখে মাছ চাষ শুরু করেছেন বীরপাশা এলাকার রূপক রায় ও সালাম খান। পার্শ্ববর্তী জয়ঘোড়া গ্রামের বিজয় কৃষ্ণ দাস, মনির খান, আ. আজিজ গাজী ও শাহাজাদা গাজী। সবজি বাগান করেছেন জয়ঘোড়া গ্রামের নাজমুল হাওলাদার। তারা সবাই পতিত পুকুর এবং জলাশয়গুলো মাছ চাষের আওতায় নিয়ে সাফল্যের হাসি হেসেছেন।

http://www.kalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=Software&pub_no=408&cat_id=1&menu_id=84&news_type_id=1&index=1

পার্বত্য অঞ্চলে নাশপাতির চাষ

বিদেশি ফল আপেলের চেয়ে দ্বিগুণ ভিটামিন ‘সি’ ও প্রোটিন সমৃদ্ধ নাশপাতি পার্বত্য অঞ্চলের একটি নতুন সম্ভাবনাময় ফল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির মাটি ও আবহাওয়া রাবি-১ জাতের নাশপাতি চাষের জন্য উপযোগী।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোট ছোট পাহাড়ে দো-অাঁশ ও বেলে মাটিতে নাশপাতি চাষ খুবই লাভজনক। পাহাড়ি খাগড়াছড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র সম্ভনাময় এই জাতের ফলের চাষাবাদ সমপ্রসারণে বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষকদের মাঝে গুটি কলম বিতরণ করে আসছে।

এখানকার আবহাওয়া নাশপাতির ফলন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য ফলের চেয়ে বেশি হওয়ায় এই ফলের চাষাবাদ দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া নাশপাতি অপেক্ষাকৃত শক্ত ফল হওয়ায় সংরক্ষণ করা যায় অধিক সময় পর্যন্ত। পচনশীল নয় বলে দেরীতে বাজারে সরবরাহ করার সুযোগ থাকায় এর দামও বেশি পাওয়া যায়। তাই অনেকে এটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় বলে মনে করেছেন। সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে রোপণের পর ৫ বছরের মধ্যে প্রতিটি নাশপাতির গাছ থেকে ৩০ থেকে ৬০ কেজি ফল উৎপাদন সম্ভব। গত কয়েক বছর ধরে এখানকার বাগান থেকে নাশপাতি বাজারে আসা শুরু করেছে।

নাশপাতি চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন এমন একজন চাষি বারাই মার্মা। তিনি এখন জেলার শ্রেষ্ঠ নাশপাতি চাষি। ২০০৪ সালে খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সহায়তায় ৮০ শতক জমিতে তিনি ৬শ’ নাশপাতির চারা রোপণ করেন। নিয়মিত পরিচর্যার পর গত ২০০৯ সালে ফলন দিতে শুরু করে গাছগুলো। তার বাগান থেকে বছরে ৫ থেকে ৭শ’ মণ নাশপাতির ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে তার বাগান থেকে বছরে কম করে হলেও ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার নাশপাতি বিক্রি করা সম্ভব। বর্তমানে পাইকারী বাজারে প্রতি কেজি নাশপাতির মূল্য গড়ে ৫০ টাকা। খুচরা বাজারে এর মূল্য প্রায় দ্বিগুণ। নিজস্ব বাগানে উৎপাদিত নাশপাতি বিক্রি করে তিনি এখন আর্থিক দিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বচ্ছল জীবনযাপন করছেন।

পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তা চন্দ্রকান্ত দাস জানান, তারা খাগড়াছড়ি বারি-১ জাতের নাশপাতি ২০০৪ সালে অবমুক্তির পর তা মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে একটি মাতৃবাগান সৃজন করেছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের গুটি কলম বিতরণের মাধ্যমে নাশপাতি সমপ্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন।

ঊধর্্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুর রউফ বলেন, প্রতি বছর গবেষণা কেন্দ্রের উৎপাদিত নাশপাতির প্রায় ২ হাজার গুটি কলম কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলায় প্রায় সহস্রাধিক সৃজিত বাগানের কৃষককে রোপণ পদ্ধতি ও বিনামূল্যে গুটি কলমের চারা বিতরণ করা হয়েছে। তাছাড়া কৃষকদের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

জীতেন বড়-য়া, বাসস

http://www.ittefaq.com.bd/content/2011/01/09/news0817.htm

কপি সাত্তার

অর্থের অভাবে লেখাপড়া না করতে পারলেও অন্যের কাছে হাত পাতেননি আব্দুস সাত্তার। বাঁধাকপির চাষ করে এলাকায় বিপস্নব ঘটিয়েছেন। বাঁধাকপি ও ফুলকপির চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে ধামরাইয়ের কেলিয়া গ্রামে বাড়ি করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভালই কাটছে তার দিন। ধামরাই উপজেলার আদর্শ কপি চাষি হিসেবে পেয়েছেন উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে একাধিক পুরস্কার। এলাকার সবাই কাছে তিনি ‘কপি সাত্তার’ নামে পরিচিত।

সরেজমিনে তার ক্ষেতে গেলে আব্দুস সাত্তার জানান, সংসারের অভাব দূর করার জন্য ১৯৯৬ সালে বাবা ২ বিঘা জমি বিক্রি করে সৌদি আরবে পাঠান। লেখাপড়া না জানায় সেখানকার কোম্পানি আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেন। এরপর বর্গা জমিতে দীর্ঘদিন পাট, ধৈঞ্চা, তামাক ও আখ চাষ করে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাতাম। ২০০২ সালে কৃষি বিভাগের পরামর্শে বর্গা জমিতেই কপির চাষ শুরু করি। তারপর আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন নিজের ৭বিঘা জমিতে এবছর বাঁধাকপি ও ফুলকপির চাষ করছি। অন্য মৌসুমে বেগুন, চালকুমড়া, করলা, পুঁইশাক ও ধান-পাটেরও চাষ করি। গত বছর কপি ও সবজি বিক্রি করে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাই। এবছরও ১ লাখ ১০ হাজার টাকার কপি বিক্রি করেছি। আগামী ১ মাসে আরো ২ লাখ টাকার কপি বিক্রি করতে পারব বলে আশা রাখছি।

ধামরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খাইরুল আলম প্রিন্স জানান, কপি চাষের জন্য আব্দুস সাত্তার আমাদের একজন আদর্শ কৃষক। তার সাফল্য দেখে কেলিয়ার চান মিয়া, কদ্দুস আলী, বারেক মিয়া, ফুকুটিয়ার আব্দুল হালিম, মাদার হোসেন, গাওয়াইল গ্রামের মফিজ উদ্দিন মাস্টারসহ অনেক কৃষক কপি ও সবজি চাষ শুরু করেছেন।

মোকলেছুর রহমান, ধামরাই, ঢাকা

http://www.ittefaq.com.bd/content/2011/01/09/news0816.htm

পাহাড়জুড়ে কুল আর কুল

এন লাভলু, রামগড়

পাহাড়জুড়ে সারি সারি আপেল কুল ও বাউ কুলের গাছ। কাঁচা-পাকা কুলের বিচিত্র বাহার। যে পাহাড়ে মানুষ ভয়ে ঢুকত না, সেখানেই অর্থনীতির নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন রামগড়ের চাষি মির্জা আবুল হাশেম।
শুরু করেছিলেন দীর্ঘ ২১ বছর প্রবাসজীবন শেষে ২০০৭ সালে দেশে ফিরে। রামগড় উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে পাতাছড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা পাকলাপাড়ায় সরকারি বন্দোবস্ত সূত্রে প্রাপ্ত এবং ১৫ একর টিলার ভূমি কিনে আপেল কুল ও বাউ কুল বাগান শুরু করেন। তিন বছর পর সেখান থেকেই আসছে ফল।
আবুল কাশেম জানান, মাঝারি ও উঁচু পাহাড়ি টিলার তলদেশ থেকে ঢালু ও শীর্ষে সারি সারি কুলগাছ লাগিয়েছেন। তাঁর বাগানে আপেল কুল ও বাউ কুল মিলে এক হাজার ৫৫০টি গাছ আছে। গত বছর থেকে পুরোদমে ফল আসছে। প্রতি গাছে আট থেকে ২০ কেজি বাউ কুল এবং ২৫ কেজি আপেল কুল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এবার অসময়ে বৃষ্টি হলেও ফলন খুব একটা কম হবে না। স্থানীয় বাজার ছাড়াও ফেনীতে কুল বিক্রি করছেন।
টিলায় চাষাবাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সেচ সংকট আর বন্য প্রাণীর আক্রমণ। এ জন্য নিজ উদ্যোগে পাহাড়ি জঙ্গলঘেরা বাগানে বিদ্যুতের লাইন নেওয়া হয়েছে। গাছে পানি সেচের জন্য স্থাপন করা হয়েছে তিনটি পাম্প মেশিন। রয়েছে পাহারাদার ও কেয়ারটেকার। প্রায় ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন বাগানে। আবুল হাশেম জানান, এখন পুরোপুরি উৎপাদনমুখী হয়েছে তাঁর বাগানটি। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন তাঁর বাগান দেখতে। তিনি নিজেও মানুষকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দেন পরিত্যক্ত অনাবাদি পাহাড়, টিলাগুলোতে এ ধরনের বাগান করতে।

সবজির চারায় দিন বদলেছে বিউটির

এমরান হাসান সোহেল, পটুয়াখালী

‘এই গাছের চারা আমাগো খাওন-পরন দেয়। এই চারার বদলে বড় পোলাডা স্কুলে যায়। এহন না খাইয়া থাকতে অয় না। ঘর দিয়া পানি পড়ে না। ভগবানের দোয়ায় কিছু টাহা পুঁজি অইছে, এহন কওলা (কবলা) কিছু জমি কিনমু। জমিডা নিজেগো অইলে যহন তহন নানা জাতের চারা লাগাইতে সুবিদা অয়।’ কথাগুলো বললেন বাউফলের মধ্যকর্পূরকাঠী গ্রামের বিউটি রানী হাওলাদার। বয়স পঁচিশ। স্বামীর নাম স্বপন হাওলাদার। অভাবের সংসারে জন্ম নেওয়া বিউটি রানীর বিয়ের পরও সুখ মেলেনি স্বামীর সংসারে। দিনমজুর স্বামীর টানাটানির সংসারে উপায়ান্তর না পেয়ে বিউটি তাঁর ঘরের পাশের ১৫ শতাংশ জমি লিজ নেন। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করে চারা উৎপাদনের খামার গড়ে তোলেন। বীজ কিনে শুরু করেন নানা জাতের সবজির চারা উৎপাদন। চারা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বামী স্বপনের সহায়তা নিয়ে স্থানীয় কালাইয়া, বগি, বাউফল, বিলবিলাস, কালিশুরী বাজারে বিক্রি শুরু করেন। সফলতা পাওয়ার পর থেকে বিউটি তাঁর স্বামীকে এ কাজে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। বিশেষ করে চারা বাজারজাত করা এবং বীজ, সার, কীটনাশক ক্রয় করার জন্য।
১২ মাস বিউটির খামারে নানা জাতের সবজির চারা উৎপাদান হয়। এর মধ্যে ফুলকপি, পাতাকপি, বেগুন, টমেটো, পেঁপে, করলা, মরিচ, লাউ, শিমসহ নানা জাতের সবজির চারা উল্লেখযোগ্য। এসব চারা উৎপাদন করে পরিবারটি আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মৌসুম অনুযায়ী প্রতি মাসে বিউটি রানী ১৫ থেকে ২০ হাজার সবজি চারা উৎপাদন করেন। তবে শীত মৌসুম সামনে রেখে বেশি চারা উৎপাদন হয় বিউটির খামারে। কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ এ তিন মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ চারা উৎপাদন করে বাজারজাত করেন বিউটি। বিউটির খামারের প্রতিটি চারা বিক্রি হয় দুই-তিন টাকা মূল্যে। শীত মৌসুমকেন্দ্রিক এসব চারা বিক্রি করেন চার-পাঁচ লাখ টাকায়। এ ছাড়া অন্যান্য মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিভিন্ন জাতের চারা বিক্রি করেন। চারার চাহিদা এত বেশি যে তা উৎপাদন করে সবজিচাষিদের চাহিদা মেটাতে পারছেন না তিনি। খামারের মাটি খনন, সেচব্যবস্থা, বীজ বপন, বাজারজাতকরণের জন্য চারা প্রস্তুতি করাসহ সব কাজই করেন তিনি। বিউটি বলেন, ‘যেকোনো মাতারিরা (মহিলারা) হ্যার সংসারের অভাব দিয়া বাঁচতে অল্প খরচে সবজি গাছের চারা তৈয়ার কইর‌্যা বাজারে ব্যাচলে কোনো ওই সংসারের অভাব থাহে না’।

বস্তায় সবজি চাষে সাফল্য

মো. শরীফুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | তারিখ: ০৩-০১-২০১১

বাসার ছাদে বস্তায় চাষ করা মিষ্টি কুমড়া

বাসার ছাদে বস্তায় চাষ করা মিষ্টি কুমড়া

রোজায় যাতে অন্তত অতি উচ্চমূল্যে কাঁচা মরিচ আর বেগুন কিনতে না হয়, সে জন্য এই দুটি সবজি চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আবদুস সালাম। তিনি কাজে নেমে শতভাগ সাফল্যও পেয়েছিলেন। নিজের রান্নাঘরের চাহিদা মেটানো শখের খামারি তিনি নিশ্চয়ই একা নন। কিন্তু আবদুস সালামের বিশেষত্ব হচ্ছে, চাষটি তিনি করেছিলেন বস্তায়।
আফ্রিকা মহাদেশের খরাপ্রবণ এলাকার জন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বস্তায় সবজি চাষের কৌশল উদ্ভাবন করেছে।
মাৎস্য চাষ বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুস সালাম প্রথম আলোকে জানান, বেশ কয়েক মাস আগে সংবাদপত্রে বস্তায় সবজি চাষে এফএওর সাফল্য নিয়ে প্রতিবেদন দেখে তিনি এ ব্যাপারে আগ্রহী হন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই পদ্ধতির আদ্যোপান্ত জেনে ছাদে বস্তায় সবজির চাষ শুরু করেন তিনি।
অধ্যাপক সালাম বলেন, ‘প্রথমেই আমি মরিচ, বেগুন, করলা, পুঁইশাক, ঢ্যাঁড়শ, কলমি, চিচিঙা ও বরবটি লাগাই। উদ্দেশ্য ছিল, রোজায় যখন বাজারে শাকসবজির দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়, তখন যেন অন্তত কাঁচা মরিচ ও বেগুন কিনতে না হয়। এতে আমি শতভাগ সফল হয়েছি।’
অধ্যাপক সালাম জানান, পরের ধাপে তিনি শসা, লালশাক ও চালকুমড়া রোপণ করে গত বর্ষায় ভালো ফলন পান। এরপর শীতের সবজি হিসেবে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, শিম, পালংশাক, স্কোয়াশ, ব্রকোলি, ধনেপাতা, লেটুস ও স্ট্রবেরি লাগিয়েছিলেন। এবারও তিনি আশাতীত সাফল্য পেয়েছেন।
অধ্যাপক সালাম বলেন, এফএওর প্রকল্প থেকে মূল ধারণা নিলেও তিনি চাষের ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। চাষের প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, বেলে-দোআঁশ মাটির সঙ্গে ছাগল ও ভেড়ার বিষ্ঠার কম্পোস্ট এবং খৈল মিশিয়ে বস্তায় ভরেছি। মিশ্রণের অনুপাত ছিল প্রতি বস্তায় ৩০ কেজি মাটির সঙ্গে ১০ কেজি কম্পোস্ট ও একপোয়া খৈল। ছত্রাকনাশকও প্রয়োগ করা হয়েছে।
এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অধ্যাপক সালামের সহযোগী তাঁর স্ত্রী বিলকিছ আক্তার জানান, তাঁরা রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখার জন্য নিয়মিত বাগান পরিদর্শন করেছেন। পোকা মারতে তামাকপাতা ও মরিচের গুঁড়া সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সাবানপানির সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করেছেন। এতে কাজ না হলে ক্ষেত্রবিশেষে রাসায়নিক কীটনাশকের শরণাপন্ন হন।
অধ্যাপক সালাম মনে করেন, বাংলাদেশের খরাপীড়িত উত্তরাঞ্চল এবং লবণাক্ততার শিকার দক্ষিণাঞ্চলে বস্তা-পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে অন্তত পারিবারিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব।
‘এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে আমি অপার আনন্দ পাওয়ার পাশাপাশি আর্থিকভাবেও লাভবান হয়েছি। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে শহরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বস্তায় সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করতে চাই।’ প্রথম আলোকে বললেন অধ্যাপক আবদুস সালাম।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কামরুল হাছান প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে বস্তায় সবজি চাষ করে সাফল্য পাওয়ার খবর এর আগে তাঁরা শোনেননি। অধ্যাপক সালামের সফলতাকে একটি ‘চমৎকার উদাহরণ’ বলে আখ্যা দেন কামরুল হাছান। তিনি বলেন, পদ্ধতিটি সফলভাবে শহরাঞ্চলে বাসার ছাদে এবং খরা ও লবণে আক্রান্ত অঞ্চলে জনপ্রিয় করা গেলে তা দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-01-03/news/120523

বোমা বানানোর রাসায়নিক আনতাম ঢাবির ল্যাব থেকে

একাত্তরের বিজয়িনী

বোমা বানানোর রাসায়নিক আনতাম ঢাবির ল্যাব থেকে

অধ্যাপক মাহফুজা খানম

মুক্তিযুদ্ধের কথা বলার আগে আমার মুক্তিযুদ্ধে আসার প্রেক্ষিতটা বলে নিই। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ডাকসুর ভিপি ছিলাম। ওই সময় দেশে ছয় দফা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এ আন্দোলনকে জনতার কাছে নিয়ে যাওয়ার পিছে ডাকসুর বড় ভূমিকা ছিল। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত গণসংযোগ করে বেরিয়েছি। ১৯৬৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সভা করার দায়ে আমার, তোফায়েল আহমেদ, রাজ্জাক ভাই, আবদুর রউফসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হলো। আমাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হলো। ১২ দিনের মতো ছিলাম জেলে। আমাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, জেল-জুলুম ছিল ভয়াবহ। আমার বিরুদ্ধে তখন ১০-১২টি মামলা ছিল। এ কারণে সে সময় কোনো স্কুল-কলেজে চাকরি পাইনি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হলাম। কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশন দিচ্ছে না। পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রে থিসিস করেছি। থিসিস ভালো হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কমনওয়েলথ বৃত্তি পেলাম। সাসেঙ্ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হলাম। কিন্তু আমাকে ভিসা, পাসপোর্ট, পুলিশ ভেরিফিকেশন দেওয়া হলো না।
তবু আন্দোলন এগিয়ে চলল। ১৯৭০ সাল থেকেই গাদা বন্দুক নিয়ে মহড়া দিতাম বুয়েট মাঠে। ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারিতে শফিক আহমেদের (বর্তমান আইনমন্ত্রী) সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। ১৯৭০-এর অক্টোবরে আমার বড় ছেলে জন্ম নিল। এর মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। সে সময় কোনো রাজনীতিবিদ ঘরে বসেছিল না। রাস্তায় নেমে এসেছে সাধারণ মানুষও। সবাই মিছিল শেষে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে জড়ো হতাম পরের দিন কী হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা নেওয়ার জন্য। সবাই বুঝতে পারছিলাম, দেশে কিছু একটা হতে চলেছে।
সে সময় ২/৩ পুরানা পল্টনে থাকতাম। ওইখানে একটা বাড়তি সুবিধা ছিল। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এলাকার পুরনো বাসিন্দা। স্থানীয় লোকজন তাদের খুব সম্মান করত। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে সুবিধা হয়েছিল।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকেই রাস্তায় নেমে গেলাম। আমরা অনেক টর্চ কিনেছিলাম। একেক জনের হাতে একটা করে দেওয়া হয়েছিল রাতে পাহারা দেওয়ার জন্য। ২৩ মার্চের পর থেকেই রাস্তায় ব্যারিকেড দিতাম। ২৫ মার্চ রাত দুটো-আড়াইটার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুরু হলো। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আগুন জ্বলতে দেখলাম। গোলার শব্দে বাসার জানালার কাচগুলো ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। আমি আর শফিক বাচ্চাকে নিয়ে খাটের নিচে চলে গেলাম। সে রাতের ভয়াবহতা ভুলতে পারি না এখনো।
২৮ মার্চ সকালে ইকবাল হল, রোকেয়া হলে গেলাম। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখলাম লাশ আর লাশ। আমার বাবার বাসা স্বামীবাগে। সেখান থেকে মা-বাবাকে আনতে যাওয়ার সময়ও রাস্তায় অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি।
স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল। অনেকেই চলে গেল ভারতে। পার্টি থেকে আমাকে ঢাকায় থাকতে বলা হলো। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় থেকেই আমি কাজ করেছি। পার্টির বিভিন্ন ইশতেহার আসত আমার কাছে। সেগুলো নটর ডেম কলেজ থেকে ফটোকপি করে এনে অন্যদের কাছে পেঁৗছাতাম। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডিপার্টমেন্ট থেকেও ফটোকপি করে এনেছি। সে সময় কবি সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ঢাকায় ছিলেন। ওঁনাদের সঙ্গে কাজ করেছি। বিচিত্রার শাহাদাত ভাইয়ের ছোট ভাই ফাত্তাহর মাধ্যমে ওষুধ, গরম কাপড়, চিঠিপত্র_এসব পাঠাতাম। এসব জিনিসপত্র প্যাকেট করা হতো আমার বাবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ অফিসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে আমার বাসায় দিয়ে যেত। আমি সেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম। চটের ব্যাগের একেবারে নিচে একপ্রস্থ সবজি রাখতাম। তারপর রাখতাম অস্ত্র। এরপর ওপরে আবার সবজি রাখতাম। কারণ পাকিস্তানি সেনারা তল্লাশির সময় ব্যাগের নিচের দিকে হাত দিয়ে দেখত।
আমি ছিলাম পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী। আমরা বোমা বানানোর ফর্মুলা তৈরি করেছিলাম। আমাদের ডিপার্টমেন্টে ফজলুর রহমান নাসের বলে একটা ছেলে ছিল। সে এসব বানাত। বোমা বানানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের ল্যাবরেটরি থেকে রাসায়নিক নিয়ে আসতাম। এ কাজে ল্যাবের রহমান ভাই খুব সাহায্য করেছেন। আমরা সেখানে গেলে উনি বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিতেন। তখন আমরা খুঁজে খুঁজে রাসায়নিক উপাদান বের করে নিতাম। একবার তো প্রায় ধরাই পড়ে গিয়েছিলাম। পাকিরা এসে দরজায় টোকা দিচ্ছিল। পরে আমরা ল্যাবের চিমনির ভেতরে লুকিয়েছিলাম।
আমি দুটো অপারেশনে সরাসরি অংশ নিই। একদিন আমরা ডিআইটি ভবনের দোতলায়, না তিনতলায় ঠিক মনে নেই, বোমা রেখে আসি। সেখানে আগে কয়েকবার গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছি। পরে চার-পাঁচজন গিয়ে টাইমবোমা রেখে আসি। বোমা ফেটে ওই ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেকটা অপারেশন ছিল তোপখানা রোডের ইউএসআইএস লাইব্রেরিতে। কারণ, ওটা ছিল আমেরিকানদের। ওরা আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। সেখানেও আমাদের পেতে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল। ওই বোমা হামলা করতে গিয়ে আমার দুই ভাই সালেহ মোস্তফা গালেব এবং সালেহ মোস্তফা জামিল ধরা পড়ে যায়। তাদের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল। তাদের শরীর প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল।
আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাও ছিল আমাদের অন্যতম কাজ। কে কোথায় আহত হয়েছে, সে খবর আমাদের কাছে আসত। সে অনুযায়ী তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাম। অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে আমার বাসায় রেখেছি। আহতদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা যেত না। কোনো ঠেলাগাড়িতে করে তাদের প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যেতাম। নিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি আর্মিরা যেন সন্দেহ না করে সে জন্য নিহতের স্ত্রী বা মা সেজে কান্নাকাটির অভিনয় করতাম। মনে আছে, এলিফেন্ট রোডের পলি ক্লিনিকের ডা. আজিজুর রহমান, ডা. আলীম চৌধুরী ও ওঁনার স্ত্রী এ বিষয়ে অনেক সহযোগিতা করেছেন।
যুদ্ধের পর দেশ পুরো বিধ্বস্ত, অর্থনৈতিকভাবে তো ছিলই। বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যা করা হয়েছে দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য। প্রাপ্তির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে আমেরিকা ও চীনের ভূমিকা ছিল। ওদের একটা নীলনকশা ছিল বাংলাদেশকে মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেওয়ার। বঙ্গবন্ধুসহ পরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করাও এসব নীলনকশার অংশ ছিল। বদলে ফেলা হলো ১৯৭২-এর সংবিধান। নিজেদের ব্যর্থতাও ছিল। সব মিলিয়ে যা আশা করেছিলাম, ততটা প্রাপ্তি হয়নি। তবে বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে তা মোটামুটি পূরণ হবে বলে আমি মনে করি।
আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একটা দেশ দিয়েছি, পতাকা দিয়েছি। আমরা একদিন থাকব না। এটাকে সমুন্নত রাখার দায়িত্ব এখন তরুণ সমাজের। তারাই বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে আরো উঁচুতে নিয়ে যাবে_ এই আশা করি।
পরিচিতি : মাহফুজা খানমের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকায়। মা সালেহা খানম, বাবা মোস্তাফিজুর রহমান খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন তিনি। স্বাধীনতার পর ইডেন কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। চাকরি জীবন শেষ করেছেন অধ্যক্ষ হিসেবে। বর্তমানে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, খেলাঘরের চেয়ারপারসন, অপরাজেয় বাংলাদেশের সভাপতি, পেশাজীবী নারী সমাজের সভাপতি, দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সহসভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। এ ছাড়া আরো কিছু সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিল; কয়েকজন রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাদে। তাই তিনি কখনো মুক্তিযুদ্ধের সনদ নেননি।
অনুলিখন : ওবায়দুর রহমান মাসুম

http://www.kalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=Politics&pub_no=381&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=3

গোলমরিচ চাষে সাফল্য

যে ক’টি কারণে পতর্ুগিজ, ফরাসি ও ইংরেজরা ভারতবর্ষে আসা শুরু করে তার মধ্যে একটি মসলা সংগ্রহ। শিল্প বিপস্নবের পর এখানে জীবনমানের প্রভূত উন্নত হওয়ার পাশাপাশি রসনার ক্ষেত্রে রুচির পরিবর্তনের কারণে মসলার চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় ভারতবর্ষে প্রচুর পরিমাণে মসলা উৎপাদন হলে বাংলাদেশে হত না। এখানকার মানুষ পাকিস্তান ও ভারত থেকে মসলা আমদানি করত। এখনো তাই করে। তবে আমাদের দেশে বিভিন্ন জেলাতে বর্তমানে কিছু কিছু মসলা উৎপাদন শুরু হয়েছে।

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা ভাদেশ্বর ইউনিয়ন খাসিয়া পুঞ্জী, যেখানে দু’শতধিক চাষি বাণিজ্যিকভাবে গোলমরিচের চাষ শুরু করেছেন। এক সময় তারা পান, আনারস ও লেবু চাষের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখন তারা গোলমরিচের ওপর নির্ভর করছেন। কেননা গোলমরিচ উৎপাদনে অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভজনক হওয়া যায়।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অদূরে প্রায় ৬০ টি এলাকা জুড়ে আলীয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জীতে হাজার হাজার গোলমরিচের গাছ প্রকৃতিকে সাজিয়েছে ভিন্নরূপে। গোলমরিচের গাছ অনেকটা পান গাছের মত দেখতে, অন্য গাছকে অবলম্বন করে বেড়ে উঠে। স্থানীয় চাষি অরুণ খাসিয়া বলেন, অতি বৃষ্টিপাতের সময় গোলমরিচের চারা রোপণ করতে হয়। এ জন্য বছরের আষাঢ়-শ্রাবণ মাস গাছ রোপণ করার উপযুক্ত সময়। গাছে ফল ধরতে সময় লাগে প্রায় ৪ বছর। তখন প্রতিটি গাছ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত গোলমরিচ পাওয়া যায়, ফল পাকার পর ছিড়ে নিয়ে রোদে শুকাতে হয়। এরপর বাজারজাত করতে হয়। এখানকার ফলের মানও ভাল।

গোলমরিচ চাষের পাশাপাশি একই সাথে সুপারিরও চাষ করা যায়। এতে যত্ন বা পরিচর্যার তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না। বাজারে এর অনেক চাহিদা থাকায় বেশ ভাল দামে বিক্রি করছেন তারা। এতে বছরে মোটা অংকের টাকা উপার্জন হচ্ছে।

হবিগঞ্জ জেলার কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতরে উপ-পরিচালক জালাল উদ্দিন জানান, বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে গোলমরিচ আমদানি হয়। দেশে যে পরিমাণ পাহাড়ি জমি রয়েছে তাতে গোলমরিচসহ অন্য মসলা উৎপাদন করা সম্ভব। বিশেষ করে হবিগঞ্জের মাটি ও পরিবেশ মসলা চাষের উপযোগী। চাষিরা ব্যাপকভাবে গোলমরিচসহ অন্যান্য মসলা উৎপাদন করতে চাইলে সরকারের কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগ যেকোনো সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

শাহ ফখরুজ্জামান, হবিগঞ্জ

http://www.ittefaq.com.bd/content/2011/01/02/news0345.htm

জৈব কৃষির এক সরব অভিযাত্রী : সেলিনা জাহান

মাটি আর ফসলের সঙ্গে নিবিড় প্রেম কৃষকের। মাটিতে অংকুরিত ফসল যেমন জানান দেয় তার খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা। বিপর্যস্ত মাটিও বলে দেয়, তার শক্তি হারানোর যন্ত্রণা। মাটি তার সর্বস্ব বিলিয়ে চলেছে ফসলের পেছনে। আমরা তাকিয়ে থাকি ফসলের দিকে। কিন্তু ফসলের ভলমন্দের জন্য যে জননীর সকল অবদান সেই মাটির কথা খুব বেশি ভাবি না। যেসব কৃষক নিবিড়ভাবে এই চিত্র উপলব্ধি করেছেন তারা সত্যিই ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন।

এই অবস্থায় সত্যিই মাটি বার বার আমাদের কাছে চাইছে পুষ্টিকর খাদ্য। মাটি- যাকে আমরা জননী বলছি, সেই জননীর ব্যথা যেন খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করছেন আরেক জননী। বলছি নরসিংদীর সেলিনা জাহানের কথা। যিনি গ্রামীণ নারীদের চার দেয়ালের ভেতর থেকে টেনে বের করে এনেছেন ফসলের মাঠে। একেকজন নারীর মনে যিনি রোপণ করেছেন স্বাবলম্বি হওয়ার ইচ্ছের বীজ। আর জানান দিয়েছেন, যে নারীর হাত দিয়ে একদিন এই কৃষির আবির্ভাব, কৃষিকে সচল রাখতে হাল ধরতে হবে সেই নারীদেরকেই।

নরসিংদীর শিবপুর, রায়পুরা উপজেলার গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পেঁৗছেছেন সেলিনা জাহান। সাংসারিক নানা সমস্যা আর সংকটে পিছিয়ে পড়া নারীরা তার চোখেই দেখেছেন এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। সবজি চাষ, পোল্ট্রি খামার, ছোট ছোট ফলের বাগান করে কেউ কেউ স্বাবলম্বিও হয়েছেন। আবার অনেকেই পরিবেশসম্মত ও বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে সাফল্য দেখিয়েছেন। এই এলাকায় চ্যানেল আই-এর হূদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেসরকারি সংগঠন সেফ এগ্রিকালচার ও স্থানীয় কৃষি বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের যে অভিযান শুরু হয়, তা স্বউদ্যোগে এগিয়ে নিয়ে যান সেলিনা জাহান। এ যেন বিষের বিরুদ্ধে এক অভিযান। ক্ষতিকর রাসায়নিকের বিরুদ্ধে এক সামাজিক আন্দোলন। যেখানে রয়েছে মাটি পরিবেশ তথা গোটা জনস্বাস্থ্যকে বাঁচানোর তাগিদ। এর ধারাবাহিকতায় গ্রামীণ নারীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন কেঁচো কম্পোস্ট অর্থাৎ জৈব সার তৈরির একটি কার্যকর অভিযানে। সেখানেও মধ্যমণি সেলিনা জাহান।

নরসিংদী শিবপুর উপজেলার সৈকারচর গ্রাম। ওই গ্রামেই সেলিনা জাহানের বাবার বাড়ি। বাড়িটির পাশেই সেলিনা তার নিজের জমিতে গড়ে তুলেছেন জৈব সার তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের আয়বৃদ্ধির প্রকল্প। শুরুটা ২১জন নারী দিয়ে। কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির এই কাজটি এখন এই নারীদের কাছে বাণিজ্যিক এক কৃষি উৎপাদন।

অল্পদিনের উদ্যোগীই এলাকার নারীরা বুঝে গেছেন প্রাকৃতিক লাঙল কেঁচোর গুরুত্ব। কোনটি হাইব্রিড কেঁচো, কোন কেঁচোর সার উৎপাদন ক্ষমতা ভাল, আর কোন কেঁচোর মাধ্যমে ভাগ্য খুলে যাচ্ছে এই হিসাবগুলো এখন সব নারীরই জানা। হাউস তৈরি, গোবর, কলাগাছ ও কচুরিপানার মিশ্রণের মধ্যে সার তৈরির মূল উপাদান কেঁচো প্রয়োগ, ৪৫ দিনে সার উৎপাদন এবং উৎপাদিত সার জমিতে প্রয়োগের উপযোগী করার কাজটির মধ্যে আলাদা এক আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন নারীরা। কারণ এখান থেকে ভালই অর্থ আসছে তাদের। আর এই উৎসাহ এখন পেঁৗছে গেছে বিভিন্ন এলাকায়। সবখানেই সেলিনা জাহানের দেখানো পথে ছুটছেন একে একে অনেকেই। নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় এখন নারীরা সংগঠিত হয়ে গড়ে তুলছেন কেঁচো কম্পোস্ট পস্নান্ট। আর পস্নান্টের একেকটি হাউস একেকজন নারীর কর্মস্থল।

নারীদের এই এগিয়ে আসা এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন মহলের আন্তরিক উদ্যোগ ও সহায়তা। এক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের খুব কাছে এসে কেঁচো কম্পোস্ট প্রকল্পকে এগিয়ে নিচ্ছেন নরসিংদীর জেলা প্রশাসক অমৃত বাড়ৈ।

কৃষি বিভাগ কীভাবে সহায়তা করেছে এ প্রশ্ন নিয়ে কথা হল স্থানীয় উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, আমরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কীভাবে কী করতে হবে তার সহযোগিতায় কমতি করছি না।

তৃণমূলে কোনো কোনো ইউনিয়ন পরিষদও জৈব কৃষির এই অভিযানে বেশ উদ্যোগী। তাদের মধ্যে একজন নরসিংদীর যশোর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন। তিনি জানালেন, এই এলাকায় কেঁচো কম্পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকেই তার ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় প্রশিক্ষণের। সেখানেই প্রথম প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সেলিনা জাহান।

এ তো গেল উৎকৃষ্ট জৈব সার উৎপাদনের প্রসঙ্গ। মাঠ পর্যায়ে এই জৈব সার ব্যবহারের কার্যকারিতায় এসেছে সুফল। এবার আমন মৌসুমে জৈব সার ব্যবহার করে তারা কীভাবে উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করেও পেয়েছেন অনেক বেশি ফলন।

যারা সবজি ফসলে এই কেঁচো জৈব সার ব্যবহার করছেন তারা শুধু সারের ব্যয়ই কমাচ্ছেন না, রীতিমত কীটনাশকের খরচ থেকেও রেহাই পাচ্ছেন। এই কেঁচো সার দেয়ার কারণে পোকা-মাকড়েরর আক্রমণ কম হচ্ছে।

এই এলাকায় জৈব সার উৎপাদন তথা এতসব সাফল্যচিত্রের পেছনে সবচেয়ে নিবিড় ভূমিকা সেলিনা জাহানের। যিনি তার জীবনকেই নিবেদন করেছেন স্বাস্থ্যকর কৃষির পেছনে। কৃষিক্ষেত্রে সেলিনা জাহানের পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও একের পর এক নতুন পদ্ধতি সম্প্রসারণের সাংগঠনিক দক্ষতা যেকোনো এলাকার শিক্ষিত সচেতন নারী-পুরুষের জন্যই হতে পারে অনুকরণীয়। সেলিনা জাহান আজ শুধু কৃষকেরই সহায়ক নন, তিনি গবেষক ও বিজ্ঞানীদের সহায়ক, সহায়ক দেশের কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার। দেশের প্রত্যেক এলাকায় এমন উদ্যোগী সংগঠক এখন সময়েরই চাহিদা।

http://www.ittefaq.com.bd/content/2011/01/02/news0340.htm

সব্জিচাষী সূখলাল